স্পোর্টস ডেস্ক:
আনরিখ নর্কিয়ার ঘণ্টায় ১৪৪ কিলোমিটার বেগের বাউন্সার কিছুই মনে হলো না তার। ০.৩ সেকেন্ড সময়ের ব্যবধানে উড়িয়ে ফেললেন গ্যালারিতে। ওই ছক্কা শুধু নয়, এর আগে-পারে চার-ছয়ের রীতিমতো বৃষ্টিই ঝরালেন রিয়ান পরাগ। সমালোচনা-ফর্মহীনতা ঝেরে যিনি আইপিএলে এসেছেন নতুন রূপে।বৃহস্পতিবার রাজস্থান রয়্যালস-দিল্লি ক্যাপিটালস ম্যাচে আক্ষরিক অর্থেই ঝড় তুলেছিলেন পরাগ। নর্কিয়ার শেষ ওভারে যে ব্যাটিং করেছেন রাজস্থানের এই ব্যাটার, তাতে চারিদিকে শুরু হয়েছে পরাগ-বন্দনা। দিল্লির দক্ষিণ আফ্রিকান পেসারের ওই ওভারে নেন ২৫ রান। সব মিলিয়ে ৪৫ বলে অপরাজিত থাকেন ৮৪ রানে। ৭ চার ও ৬ ছক্কায় সাজানো ওই ইনিংসে ম্যাচসেরার পুরস্কারও জিতেছেন পরাগ।এই পারফরম্যান্স দিয়ে কি নিন্দুকদের গালে চপেটাঘাত-ও করলেন না তিনি? মাত্র কয়েক বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে সমালোচনার তীরে তো কম বিদ্ধ হতে হয়নি। মাঠে তিনি সবসময় প্রাণচঞ্চল মানুষ। ফিল্ডিংয়ের সময় গানের তালে নাচতেও দেখা যায়। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি ট্রলের শিকার হয়েছেন খুব। ‘খেলা বাদ দিয়ে নাচের প্রতিযোগিতায় নাম লেখানো উচিত তার’- এই ধরনের কথাও শুনতে হয়েছে পরাগকে।২০১৯ সালের আইপিএলে তার বয়স ছিল মাত্র ১৯ বছর। রাজস্থান দিয়ে অভিষেক হয় ভারতীয় টি-টোয়েন্টি প্রতিযোগিতায়। বয়স কম হলেও মানসিকভাবে শক্তিশালী এই ক্রিকেটারকে ভারতীয় ক্রিকেটের ‘বড় সম্পদ’ বলে মনে করা হয়েছিল। তার পরিপক্কতা অনেককেই মুগ্ধ করেছিল। আলাদা জায়গাও তৈরি করে দিয়েছিল দুর্দান্ত ফিল্ডিং। কিন্তু মূল কাজ ব্যাটিংয়ে ছিল যাচ্ছেতাই পারফরম্যান্স। ফলে ওই বয়সেই সমালোচনায় শিকার হওয়া শুরু তার।গত বছরের আইপিএলও ভালো যায়নি পরাগের। যাতে তার সামর্থ্য ও ক্রিকেট মানসিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সেই পরাগ এবার দাঁতভাঙা জবাব দিচ্ছেন। আইপিএলের দুই ম্যাচেই বুঝিয়ে দিয়েছেন, ‘এই পরাগ সেই পরাগ নয়।’ লখনউ সুপার জায়ান্টসের বিপক্ষে ৪৩ রানের পর দিল্লির বিপক্ষে হার না মানা ৮৪ রানের টর্নেডো ইনিংস। তাতে প্রচারের আলো পড়তে শুরু করেছে পরাগের ওপর।ওই ম্যাচ দুটিতে চার নম্বর পজিশনে ব্যাটিং করেছেন তিনি। এই পজিশনে অন্তত ১ হাজার রান করেছেন, এমন ক্রিকেটারদের মধ্যে মাত্র দ্বিতীয় ব্যাটার হিসেবে পরাগের স্ট্রাইকরেট ১৫০ ও গড় ৪০-এর বেশি। এই তালিকায় থাকা অন্য ব্যাটার এবার টিভির সামনে দেখেছেন পরাগের চার-ছক্কার বৃষ্টি। তিনি সূর্যকুমার যাদব। যিনি চার বছর আগে পরাগের জায়গায় ছিলেন। সিনিয়র ক্রিকেটাররা যেমন তাকে প্রশংসার বৃষ্টিতে ভিজিয়েছেন, সমান্তরালে ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছ থেকেও পেয়েছিলেন ভালোবাসা। ভারতের তখনকার কোচ রবি শাস্ত্রীও ছিলেন এই দলে। টুইটারে লিখেছিলেন, “সূর্য প্রণাম। এভাবেই শক্তিশালী থাকবে এবং ধৈর্য ধরবে।”আর এবার সূর্যকুমার লিখলেন পরাগকে নিয়ে, “কয়েক সপ্তাহ আগে ন্যাশনাল ক্রিকেট একাডেমিতে একটা ছেলের সঙ্গে দেখা হয়। কিছুটা চোট সমস্যা ছিল। যার পুরোপুরি নজর ছিল পুনর্বাসনের দিকে। স্কিল অনুশীলনে শৃঙ্খলতার সঙ্গে কাজ করে গেছে। একজন কোচ এসে আমাকে জানালেন, “সে পুরোপুরি বদলে গেছে।’ রিয়ান পরাগ দুর্দান্ত।”সত্যিই বদলে গেছেন পরাগ। ২০২৩ সালের আইপিএলে যেখানে ৭ ম্যাচে তার রান ছিল ৭৮। সেখানে এবার দুই ম্যাচ খেলেই টপকে গেছেন ওই রান (১২৭)। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হলো, দিল্লির বিপক্ষে বিস্ফোরক ইনিংস খেলার সময় পুরোপুরি সুস্থই ছিলেন না তিনি। খেলার প্রতি একাগ্রতা ও প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি তাকে লক্ষ্য থেকে সরাতে পারেনি। তিন দিন ব্যথায় কাঁতর ছিলেন, ওষুধ খেয়ে নামতে হয়েছিল মাঠে। অথচ তার ব্যাটিংয়ে সেটির কোনও ছাপই খুঁজে পাওয়া যায়নি।কীভাবে বদলে গেলেন পরাগ? কোন জাদুর কাঁঠির সন্ধান পেয়েছেন গুয়াহাটির এই ক্রিকেটার? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে ভারতীয় ঘরোয়া ক্রিকেটের অন্য প্রতিযোগিতাগুলোর দিকে তাকাতে হবে। যারা ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটের খোঁজ-খবর রাখেন, তাদের কাছে পরাগের এই পারফরম্যান্স মোটেও চমকপ্রদ নয়। কারণ তিনি রানের মধ্যেই আছেন। ৫০ ওভারের প্রতিযোগিতা দেওধর ট্রফির সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক এই পরাগ। সবচেয়ে বেশি ছক্কাও তার। দুটি সেঞ্চুরি পূরণের সঙ্গে পাঁচবার গিয়েছিলেন শতকের কাছাকাছি। সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফিতেও পরাগের দাপট। এই টি-টোয়েন্টি প্রতিযোগিতায় ১৮২.৭৯ স্ট্রাইকরেটে করেছেন ৫১০ রান। ৫০ ছাড়ানো ইনিংস আছে সাতটি।অর্থাৎ, ঘরোয়া ক্রিকেট দিয়ে আগেই নিজেকে তৈরি করে রেখেছিলেন পরাগ। যেটি এখন বড় আকারে প্রদর্শন হচ্ছে এবারের আইপিএলে। এই প্রতিযোগিতার ব্যাপকতা এত যে, নজরে পড়া যায় খুব তাড়াতাড়ি। এখানে ভালো দিক যেমন আছে, তেমনি আছে খারাপ দিক। কেউ রান বা উইকেট পেলেই হইচই পড়ে যায়, আবার খারাপ করলে সমালোচনার তীরে বিদ্ধ হন। এই বিষয়টা পরাগের চেয়ে ভালো আর কে জানেন!নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে এই ক্রিকেটারের উপলব্ধি, ‘আমি অনেকবারই কথাটা বলেছি। আমি জানি নিজের সম্পর্কে আমার ধারণা কী। কে কী বলল তাতে আমার কিছু যায়-আসে না। কারণ আমি তাদেরকে পাল্টাতে পারব না। আমি যেটা পারি, সেটা হলো নিজেকে নিয়ে মূল্যায়ন করা।’ সঙ্গে যোগ করেছেন, ‘ভালো করলে আমার প্রশংসা করা হবে, খারাপ করলে উল্টোটা শুনতে হবে। আমি তো কারও ভাবনা বদলাতে পারব না। সে কারণে আমি নিজেই নিজেকে সবসময় সমর্থন দিয়ে যাই।’প্রশংসা কিংবা সমালোচনা- কোনোটই গায়ে মাখেন না তিনি। নিজেকে নিজেই ‘গাইড’ করেন। আর এই তত্ত্ব পাল্টে দিয়েছে তার ক্রিকেট-জার্নি। প্রচারের আলোয় পড়ায় যে ক্রিকেটারকে নিয়ে এখন ?খুব মাতামাতি হচ্ছে। কথা হলো, সেটা কি প্রভাবিত করতে পারছে পরাগকে?
Sharing is caring!