৭ই এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৪শে চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ই শাওয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

দেশের অর্থনীতি এখন ভঙ্গুর, অস্থিতিশীল

admin
প্রকাশিত জুন ১১, ২০২৪, ০৪:২৭ অপরাহ্ণ
দেশের অর্থনীতি এখন ভঙ্গুর, অস্থিতিশীল

বিশেষ প্রতিবেদক:
দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মৌলিক দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে। শুধু আয়-ব্যয়ের হিসাব মিলিয়ে এই দুর্বলতা কাটানো যাবে না। এই পরিস্থিতিতে বড় ধরনের গুণগত পরিবর্তন দরকার। কিন্তু সরকারের উচ্চতম মহলে সেই উদ্যোগ আছে কি না এমন প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি বলেন, বিভিন্ন অনুগত স্বার্থগোষ্ঠীকে ব্যাংক থেকে অন্যায় সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে, যার সঙ্গে ক্ষমতার রাজনীতি সম্পৃক্ত। এ ধরনের পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়ে, বিনিয়োগের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সৎ উদ্যোক্তারা নিরুৎসাহিত হন। পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে হলে আর্থিক খাতসহ কিছু সংবেদনশীল খাতকে ক্ষমতার রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে হবে। দেশ থেকে পুঁজি পাচার হচ্ছে, ব্যাংক খাত আছে বিশৃঙ্খল অবস্থায়। বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে বাজেট যেন হাত-পা বাঁধা বলির পশুর মতো, তার কিছু করার নেই। সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতি ভঙ্গুর ও অস্থিতিশীল অবস্থায় আছে। নিউজ পেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) ও সম্পাদক পরিষদ আয়োজিত ‘অর্থনীতির চালচিত্র ও প্রস্তাবিত বাজেট ২০২৪-২৫’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি। রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন ও সাবেক অর্থসচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী। সম্পাদক পরিষদের সভাপতি মাহফুজ আনামের সভাপতিত্বে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য দেন—নোয়াব সভাপতি এ কে আজাদ এমপি, দৈনিক যুগান্তরের প্রকাশক অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও দৈনিক বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ। আলোচনাসভায় এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার সমালোচনা করা হয়। পাশাপাশি বাজেট ভর্তুকির অর্থ যোগাতে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধির বিষয়ে উদ্বেগ জানানো হয়। তারা বলেন, এর প্রভাবে ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ সংকুচিত হবে। বক্তৃতায় দেশের অর্থনীতির এক বিশৃঙ্খল পরিবেশের চিত্র তুলে ধরেন অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি বলেন, অর্থনীতির সবচেয়ে সংবেদনশীল খাত ব্যাংকিং খাত এখন নিয়ন্ত্রণহীন ও অরক্ষিত। অর্থনীতিতে নেই আস্থার পরিবেশ। অবাধে কালোটাকার সঞ্চালন হচ্ছে। পাচার হচ্ছে অনেক টাকা। অর্থনীতিতে সমস্যা আগে থেকেই ছিল, কিন্তু এত দিন সেই সমস্যা হজম করার শক্তি অর্থনীতির ছিল। এখন সেই শক্তি নেই বলে এসব সমস্যা প্রকাশ্যে আসছে। এই বাস্তবতায় দৃঢ় পথ নির্দেশনা দরকার বলে মত দেন তিনি। ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ আরো বলেন, আমরা একটি নৈতিকতাহীন অর্থনৈতিক অবস্থার দিকে এগোচ্ছি। এখন যে পথে অর্থনীতি চলছে, সেই পথের পরিবর্তন না হলে ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। বিশ্বের দুর্নীতি প্রায় সব দেশে আছে, কিন্তু বাংলাদেশ শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এর অন্যতম কারণ সরকারি সেবা পেতে নাগরিকদের অর্থ ব্যয় করতে হয়। এদেশে ঘুষ দেওয়া অপরাধ নয়, কিন্তু ঘুষ খাওয়া অপরাধ। অথচ ভারতে ঘুষ দেওয়াও অপরাধের মধ্যে গণ্য করা হয় ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হয়নি, যদিও দেশে অনেক দিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এটা বিবেচনাপ্রসূত হয়নি বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, কর নীতি দেখে মনে হয়, বাঘের হরিণ শিকার করার নীতিতে চলছে রাজস্ব ব্যবস্থা। অর্থাৎ ছোট ও ক্ষমতাহীনদের চাপে রাখা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে অর্থনীতিতে নৈতিকতা নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। সরকার এখন স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে চায়। কিন্তু স্মার্ট মানুষ নীতিহীন হলে ভয়ংকর পরিস্থিতি হয়। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীরের প্রসঙ্গে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, আর্থিক খাতে অনিয়ম ধরতে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট রয়েছে। এখন দেশের যে কোনো ব্যাংকে ১০ লাখ টাকার লেনদেন হলেই তারা এটা তদারকি করে। পুলিশের সাবেক প্রধান বেনজীরের অ্যাকাউন্টে এত টাকা লেনদেন হলো, সেগুলো কী ভাবে হলো? কেন ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট সে সময় লেনদেন খতিয়ে দেখল না—এমন প্রশ্ন রাখেন তিনি।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, একটি গ্রুপ অনৈতিক সুবিধা নিয়ে ফুলেফেঁপে উঠছে। এই বাজেটে সরকার সুবিধাভোগীদের কথাই শুনেছেন। ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার কমিয়ে আনলে ভর্তুকি আরও কমানো যেত। সরকারের ব্যয়ে অপচয় রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগ আছে যেগুলোর কোনো প্রয়োজন নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র ১১টি মন্ত্রণালয় দিয়ে চলছে। বাজেটের বড় অংশ চলে যাচ্ছে বেতন-ভাতায়। প্রতিষ্ঠান সংখ্যা কমিয়ে এনে এসব খাতে খরচ কমানো সম্ভব। ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ স্থবির উল্লেখ করে ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকার ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি ঋণ নেবে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো যত টাকা বিতরণ করবে তার ৭৬ শতাংশই নিয়ে যাবে সরকার। তাহলে ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ বাড়বে কী করে? মূল্যস্ফীতি কমাতে যে উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে সেটির সুফল পেতে অন্তত জানুয়ারি পর্যন্ত ধৈর্য ধরতে হবে। শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতিও ৭০ শতাংশ হয়েছিল, সঠিক আর্থিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এটি কমিয়ে এনেছে তারা। ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে সংস্কারের বিষয়গুলো নেই। ব্যাংকিং খাত ভঙ্গুর থেকে ভঙ্গুর হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষও ব্যাংকে গিয়ে নিজেদের টাকা তুলতে পারছে না। বাজেটের দর্শন হয়ে গেছে সুবিধাবাদীদের সুবিধা তৈরি করা। নোয়াব সভাপতি এ কে আজাদ এমপি বলেন, সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ বাড়িয়ে ঘাটতি পূরণে কথা বলেছেন। কিন্তু ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ বৃদ্ধি করলে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাবে। এর প্রভাবে বিনিয়োগ কমে গেলে কর্মসংস্থানে প্রভাব পরবে। অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম বলেন, এখন বিজ্ঞাপন প্রচারে অনলাইন বিভিন্ন মাধ্যমকে বেছে নেওয়া হচ্ছে। দৈনিক পত্রিকাগুলো বিভিন্ন ধরণের সমস্যা মোকাবিলা করছে। সংবাদপত্র শিল্পে সব ধরণের কর মওকুফের আহ্বান জানান তিনি।

Sharing is caring!