২০শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২২শে শাওয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

সম্ভাবনার বাঁশ শিল্প অস্তিত্ব সংকটে, দেখার কেউ নেই

admin
প্রকাশিত জুলাই ৬, ২০২৪, ০২:১২ অপরাহ্ণ
সম্ভাবনার বাঁশ শিল্প অস্তিত্ব সংকটে, দেখার কেউ নেই

নিজস্ব প্রতিবেদক:
অস্তিত্বের সংকটে পরিবেশবান্ধব এই বাঁশশিল্প। এটি আমাদের দেশে লোকশিল্প হিসেবে পরিচিত। বাঁশ গ্রামীণ জীবনে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হলেও এর ব্যবহার অল্প বিস্তর শহরেও আছে। তবে গ্রামে অতি প্রয়োজনীয় কাজে এই বাঁশ এবং বাঁশশিল্পের ব্যবহার হলেও শহরে বাঁশ দিয়ে তৈরি পণ্য সাধারণত শৌখিন পণ্য হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। একসময় বাড়ির পাশে বাঁশঝাড় ছিল গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের চিরায়ত রূপ। তবে নির্বিচারে বৃক্ষ-উদ্ভিদ উজাড় করার কারণে অস্তিত্বসংকটে হারিয়ে যেতে বসেছে পরিবেশবান্ধব এই উদ্ভিদ ও এর তৈরি শিল্প। কালের বিবর্তনে বাঁশ-বেড়ার বাড়িঘরের বদলে স্থায়িত্বশীল ইট, সুরকি ও পাথর দিয়ে আবাসস্থল তৈরির কারণে এবং শহরে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর প্রভাবে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে এই বাঁশশিল্পের ব্যবহার। তবে এই শিল্প আগাগোড়াই প্রাকৃতিক ও পরিবেশবান্ধব। এই শিল্পের প্রধান উপকরণ বাঁশ। সাধারণত গ্রামীণ জনগণ এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত এবং বেশির ভাগ পণ্য তারাই ব্যবহার করেন। ঘর, মাচা, মই, মাদুর, ঝুড়ি, কুলা, চালুন, খলই, মাছধরা পলো, মাথাল, সোফা, বই রাখার র্যাকসহ হস্তশিল্পের নানা সামগ্রী তৈরিতে বাঁশ ব্যবহূত হয়। বাঁশ তার স্থায়িত্ব ও বহু ব্যাবহারিক গুণাবলির জন্য কালক্রমে লোকসংস্কৃতি ও কারুশিল্পের অন্যতম উপকরণ হয়ে ওঠে। বাঁশের তৈরি এই শিল্প দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ছাড়াও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবনে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। বাঁশ দিয়ে তৈরি মাদুর, বাঁশের ঝুড়ি, অলংকৃত দেওয়ালসজ্জায়ও বাঁশ ব্যবহূত হয়। বাংলাদেশের লোকজীবনের খুব কম দিকই আছে যেখানে বাঁশের তৈরি সামগ্রী ব্যবহার হয় না। বাঁশের হাতপাখা গ্রামে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া ঘরের দোচালা, চারচালা, ঘরের বেড়া, ঝাঁপ, দরজা বাংলাদেশের নিজস্ব শিল্প-সংস্কৃতির প্রতীক। আত্মরক্ষার কাজে ব্যবহৃত বর্শা, ঢাল, লাঠি, তির, ধনুক ও বল্লম হিসেবে বাঁশের ব্যবহার লক্ষণীয়। লোকবাদ্য যন্ত্রের অন্যতম অনুষঙ্গ বাঁশি একতারা, যা বাঁশ দিয়ে তৈরি হয়। বাঁশের তৈরি মোড়া সেই দীর্ঘ বছর ধরে শহর ও গ্রামে বসার অনুষঙ্গ হিসেবে সমান জনপ্রিয়ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। গ্রামীণ জীবনে বাঁশের তৈরি মাদুর আর নগরজীবনে বাঁশের তৈরি ফটো ফ্রেম, আয়না ফ্রেম, দোলনা, সোফা, ছাইদানি, ফুলদানি, প্রসাধনী বাক্সের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষণীয়। এছাড়া চা-বাগানে পাতা তোলার ঝুড়ি, খাসিয়াদের পান রাখার ঝুড়ি এবং বিভিন্ন উপজাতীয়দের দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত বাঁশের তৈরি গৃহস্থালি পাত্রগুলো সবাই রঙিন নকশা করা বাঁশশিল্পের নমুনা।
কী এই বাঁশ: বাঁশ আমাদের দেশের মাটিতে বেড়ে ওঠা একধরনের শক্ত উদ্ভিদ। এই উদ্ভিদকে গাছ বলা হয় না। এটি একধরনের চির সবুজ বহু বর্ষজীবী উদ্ভিদ, যা নাতিশীতোষ্ণ ও গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে জন্মায়। বাঁশ সাধারণত একত্রে ঘাসের মতো গুচ্ছ হিসেবে জন্মায়। একটি গুচ্ছে ১০ থেকে ৭০ কিংবা ৮০টি বাঁশ একত্রে দেখা যায়। যাকে ‘বাঁশঝাড়’ বলে। বাঁশ দেখতে চিকন বা সরু মসৃণ লম্বাটে, এর গায়ের ও পাতার রং গাঢ় সবুজ। বাঁশকে ঘাস পরিবারের বৃহত্তর সদস্যও বলা হয়। পৃথিবীতে ৩০০ প্রজাতির বাঁশ আছে। একটি বাঁশঝাড় তার চারপাশে তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি পর্যন্ত ঠান্ডা রাখতে সক্ষম।
সম্ভাবনাময় বাঁশশিল্প: দেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে সাধারণত মুলি ও ডলু—এ দুই ধরনের বাঁশই বেশি জন্মায়। ভাইজ্জা নামক ডলু ও মুলি বাঁশের চেয়ে অপেক্ষাকৃত মোটা। এই বাঁশের জাতটি সিলেট অঞ্চলে বেশি দেখা যায়। অনেকেই আবার ভাইজ্জা নামক বাঁশটির বাগানও করে থাকে। নানা জিনিস তৈরির পাশাপাশি ভাইজ্জা বাঁশ উঁচু বিল্ডিং রং করা বা মেরামত করার কাজে ব্যবহৃত মই তৈরির কাজে লাগে। বর্তমান ডিজিটাল দুনিয়ার কারণে বিশ্বজোড়া ছড়িয়ে পড়েছে অনলাইন শপের বাণিজ্য। ফলে বাঁশের তৈরি পণ্যের ব্যবহার আবারও বিশ্বজোড়া ছড়িয়ে পড়তে পারে। এসব পণ্য আড়ংসহ বিভিন্ন জেলায় বিক্রি করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের বাঁশের তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী, যা আমাদের দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে দিতে সহায়তা করছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঁশ অনেকটাই প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম নেয় এবং সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠে। একসময় পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঁশ কর্ণফুলী পেপার মিলের কাগজ তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বাঁশের বহুবিধ ব্যবহারের ফলে গ্রামীণ এই উদ্ভিদ একসময় শিল্পে রূপ নেয়। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অসংখ্য মানুষ, যারা বাঁশ দিয়ে বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে। প্রকৃতপক্ষে বাঁশের বহুবিধ ব্যবহার বাঁশশিল্পকে সম্ভাবনাময় শিল্প হিসেবে দেখা যাচ্ছে। তবে এ শিল্পকে সব মানুষের ব্যবহার উপযোগী করার জন্য এর ব্যাপক প্রসার ঘটাতে হবে। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত অনেকেই এখন তাদের বাপ-দাদার এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যেতে চাইছেন। কিছু কারিগর এখনো রয়েছেন তাদের বাপ-দাদার পেশাকে আঁকড়ে ধরে। তারা এ শিল্পের ওপর নির্ভর করেই জীবিকা নির্বাহ করতে চান। কারণ তারা অন্য কাজ জানেন না বলে জানান। টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার ডুবাইল ইউনিয়নের বেশ কটি গ্রামের অধিকাংশ পরিবার বাঁশশিল্পের কাজ করেন। এ শিল্পের কারিগর বদি মিয়া বলেন, ‘আমরা আমাদের পূর্বপুরুষের পেশাকে আঁকড়ে ধরে বাচতে চাই। এই কাজে অন্য রকম একটা আনন্দ খুঁজে পাই। এ কাজের পয়সায় এখন আর সংসার চলে না। আমাদের ছেলেরা এখন আর এই কাজ করতে চায় না। অন্য একজন কারিগর রহমত আলী বলেন, বাঁশশিল্পে কোনো ক্ষতিকর সামগ্রী নেই, এটা পুরোটাই পরিবেশবান্ধব। এখন এই শিল্পকেই প্রণোদনা দেওয়া দরকার।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজে লাগালে আমরাও উপকৃত হব এবং দেশীয় এই বাঁশশিল্পও এগিয়ে যাবে।’

Sharing is caring!